হেপাটাইটিস C রোগ ও চিকিৎসা
১. হেপাটাইটিস C ভাইরাসএকটি লিভারের ক্ষতিকর জীবানু। সারা বিশ্বের জনসংখ্যার ০.৫% থেকে ৬.৫% পর্যন্ত মানুষ এই রোগের জিবানু দ্বারা আক্রান্ত। প্রতিবৎসর প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ C ভাইরাস জনিত রোগে মারা যাচ্ছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ সঠিক হিসাব না থাকলেও প্রাথমিক গবেষণায় জানা যায় যে ০-৫-১% মানুষ হেপাটাইটিস C ভাইরাস বহন করে যাচ্ছে।
Diagram of C virus
২. হেপাটাইটিস C একটি রক্ত বাহিত অসুখ। রক্ত বা রক্ত জাতীয় জিনিষ জিবানু মুক্ত না করে রোগীকে দেওয়া, একই সাথে কয়েক জন মিলে ইনজেকশনের মাধ্যেমে নেশার ঔষধ নেওয়া,শরীরে উলকি বা tattoo কাটার মাধ্যেমে প্রধানত C রোগ ছড়ায়। এছারা ভাইরাস মুক্ত নয় এমন ডায়ালাইসিস মেশিনে ডায়ালাইসিস মাধ্যেমে কিডনী রোগী C ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এছাড়াও সেলুন এ জীবানু মুক্ত না করা রেজর, ব্লেড ব্যাবহার করাও একটা মাধ্যম যাহা সাধারনে মধ্যে চিন্তাতে আসে না। হেপাটাইটিসি C ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সাথে যৌনমিলনে অল্পসংখ্যক (৫%)রোগীর এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।এখানে জানা দরকার যে C ভাইরাসের আক্রান্ত গর্ভবতি মায়ের থেকে সন্তান প্রসবের সময় খুব কম সংখ্যক নবজাতক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। মোটকথা C ভাইরাস যুক্ত যে কোন জিনিষ ব্যাবহারে রক্তে যে কোন পন্থায় প্রবেশের মাধ্যেমে রোগ ছড়ায়। হেপাটাইটিস C আক্রান্ত মায়ের দুধ নিরাপদ ভাবে বাচ্চাকে খাওয়ানো যাবে। তবে এই ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে স্তন ও স্তনের বোটায় কোন ঘা না থাকে।
৩.হেপাটাইটি C ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর ১৫-১৮০ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকে। যদিও অধিকাংশে মানুষের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার পর ও কোন রোগ লক্ষন দেখা দেয় না। মাত্র ১২% মানুষের জন্ডিস দেখা দিতে পারে। খাওয়ার অরুচি, পেটে ব্যাথা, বমি, ও বমি বমি ভাব, দুর্বলতা, গায়ে চুলকানি হতে পারে। হেপাটাইটিস C রোগে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ১৫-৪০ ভাগ রোগীর ভাইরাস ৬ মাসের মধ্যে রক্ত থেকে চলে যায়। এসব রোগীদের স্বল্প মেয়াদি বা একিউট হেপাটাইটিসে আক্রান্ত বলে ধরা হয়। বাকি ৬০-৮৫ ভাগ রোগী দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক হেপাটাইটিস c রোগে আক্রান্ত হন।
৪. দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস C রোগে কয়েকটি স্তর পার করার পর লিভার সিরোসিসে রুপান্তরিত হয়। লিভার সিরোসিস একটা মারাত্মক অসুখ। আক্রান্তদের মধ্যে ২০-২৫% রোগী ২০-২৫ বৎসরের পর এই সিরোসিস স্তরে উপনিত হয়।পরিনামে লিভার ফেলিইউর, লিভার ক্যানসার, পেটে পানি আসা, ও রক্তবমি হয়।
শেষ পর্যায়ে লিভার প্রতিস্থাপন (transplant) করার মাধ্যেমে কিছু রোগী সুস্থ হন। প্রাথমিক ভাবে রোগ লক্ষন ছাড়া হেপাটাইটি C এর একটা বড় অংশ লিভারের অসুখের শেষ পর্যায়ে চলে যায়। সেইজন্য হেপাটাইটি C রোগ নিবর খাতক হিসেবে চিননিত।
৫. হেপাটাইটিস C রোগে আক্রান্ত রোগীকে ant- HCV এবং HCV- RNAদ্বারা রোগ সনাক্ত করা হয়। পরে লিভার ও ভাইরাসের বিভিন্ন অবস্থান জানতে আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়। ALT, AST, alkaline phosphatase, bilirubin বাড়তে পারে Ultrasound, CT এবং MRI এর মাধ্যেমে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার ধরা যায়।
৬. হেপাটাইটিস সি রোগের চিকিৎসা এখন নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। গত আশির দশকে এই ভাইরাসে অস্তিত্ব খুজে না পাওয়ার কারনে এই ভাইরাস কে Non -A Non -B ভাইরাস হিসেবে ধরে নেওয়া হত। কারন ঐসময়ে হেপাটাইটি এ ও বি ভাইরাসকে ডাক্তাররা জানত। এই সময়ে Non A Non B হিসেবে দির্ঘ মেয়াদি লিভার রোগ কে উন্নত বিশ্বে Steroid ট্যাবলেট দিয়ে চিকিৎসা করা হত। সিডলী বিশ্ববিদ্যালয়ে লিভার মেডিসিন PhD করার সময় এসব রোগী যাদের পরিবর্তিতে hepataitis C দ্বারা আক্রান্ত বলে প্রমানিত হয়েছিল, তাদের অনেক medical record রিভিউ করি। তাদের পূর্বের চিকিৎসা অর্থাৎ Steroid চিকিৎসারর মাধ্যেমে রোগীর উন্নতি হচ্ছে এমন অনেক বিশষজ্ঞদের comment তাদের নোট এ দেখে হাসির উদ্রেগ হত। নতুন নতুন ঔষধের কারনে আজ এ চিকিৎসার যুগান্তিকারি সাফল্য বয়ে এনেছে। নব্বই দশকে এই রোগের জন্য ইন্টারযোরন নামে একটি এন্টিভাইরাস ইনজেকশন ব্যাবহার শুরু হয়। শুরুর প্রথম দিকে ঔষধের কার্যকারিতা প্রমানিত হয়। কিন্তু অল্প সংখ্যক রোগী এই চিকিৎসা রোগ মুক্ত হোত।
৭. ১৯৯৫-১৯৯৯ এই ৫ বৎসরে সিডনী ওয়েষ্টমিড হাসপাতালের হেপাটাইটিস C ভাইরাস রেগীদের ইন্টারফেরন চিকিৎসার ফল পর্য্যালোচনা করে আমরা দেখলাম ৫ – ১০% রোগীর এই চিকিৎসারর রোগ মুক্ত হচ্ছে। এর পর আরও উন্নত মানের ইন্টারফেরন যেমন পেগ ইন্টারফেরন একক ভাবে এবং মুখের খাওয়া ক্যাপসুল রাইবা ভাইরিন মিশ্রিত চিকিৎসায় আরও বেশি লোক (৪০-৬০%) রোগ মুক্ত হতে থাকলো। এসময়ের একটা রোগীকে ৬ মাস -১ বৎসর মেয়াদি চিকিৎসা আমাদের দেশে ৬-১০ লক্ষ টাকা ব্যায় হতো।
৮. চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষকদের নিরলস চেষ্টায় গত কয়েক বৎসর নতুন ঔষধের কারনে রেগী ও চিকিৎসকের মুখের হাসি ফুটে ওঠে। সরাসরি সি ভাইরাস কে মারতে পারে এমন ধরনের বহুু ঔষধ. উন্নত বিশ্বের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আাকাশ চুম্বি দামের কারনে রোগীরা এর নাগালের বাইরে এসব ঔষধ একটি ৩ মাসের চিকিৎসা সম্পুন্ন করতে পারি ৪০-৮০ লাক্ষ টাকা উন্নত বিশ্বে খরচ হয়। কিন্তু ইষানিত সাফল্যে প্রায় শতভাগ রোগী মুক্ত হয়। সরকারি প্রচেষ্টায়
আজ আমাদের দেশে এসব ঔষধ দেশিয় ভাবে অনেক ঔষধ কোম্পানিতে তৈরী করেছে। চিকিৎসা এখন মোটামুটি নাগালের মধ্যে দামেও উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক কম। ১ – ১/২ লক্ষ টাকার ৩ মাসের একটি কোস করায় ৯৫ – ১০০% রোগী রোগ মুক্ত হয়ে যাচ্ছেন।
৯ . এটা জানা দরকার যে hepatitis C চিকিৎসা কার্যকর হলে লিভার ক্যানসারের ঝুকি কমে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে লিভার সিরোসিস থেকে লিভারকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসে যাহা ফ্রান্সের একজন চিকিৎসক বিজ্ঞানীর গবেষণার প্রমাণিত। সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ে হেপাটাইটিস C এর গবেষণা নিয়ে PhD করার সময় আমরা প্রমান করেছি যে চিকিৎসা কার্যকর হলে লিভারের বিভিন্ন জটিলতা কমে। হেপাটাইটিস C চিকিৎসার সময় মদ্যপান, অন্য ভাইরাসের উপস্থিতি, লিভারের অতিরিক্ত লৌহা জম ও লিভারের চর্বি ভাইরাসের চিকিৎসারর ফলাফল কমিয়ে দেয় বিশেষ করে ইন্টারফেরন চিকিৎসা।
১০ অষ্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডে যৌথ ভাবে ৪৬ টা লিভার সেন্টার মিলে হেপাটাইটিস C ভাইরাসের ঔষধ, পেগ ইন্টারফেরন ও রাইবাভাইরিন মিশ্রিত চিকিৎসারর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষনা রত ছিল। এর একটি কেন্দ্র ছিল নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যাল্য হাসপাতালের লিভার সেন্টার। লিভার মেডিসিনে PhD করার পর post doctoral clinical fellow হিসেবে এই সেন্টারে প্রফেসর আমাকে একজন ট্রায়াল কো ইনভেষ্টিগেটর নিযুক্ত করেন। এখানে ৪৬ জন রোগীর আমার তত্ববধানে চিকিৎসারর সময় হেপাটাইটিস C চিকিৎসার বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বুঝেছি এই চিকিৎসার জটিলতা কতটুকু। এজন্য অভিজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে রোগীর চিকিৎসা করা প্রয়োজন। চিকিৎসক রোগী,রোগের ও ভাইরাসের অবস্থান এবং পারিপার্শিক অবস্থা বিবেচনা করে সুচিকিৎসার ব্যাবস্থা করবেন।