জীবন বিপন্নকারী অসুখ : রক্তবমি ও কালো পায়খানা
জীবন বিপন্নকারী অসুখ : রক্তবমি ও কালো পায়খানা
সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা তখন আমি মেডিকেলের ফাইনাল ক্লাশের ছাত্র। গ্রামের বাড়িতে আমার এক পরিচিত গ্রামবাসী দাঁতের ব্যথার জন্য ঔষধ লিখতে বললো। সাধারণ প্যারাসিটামল খাওয়ার পরও সে অসহ্য দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলো বলে তাকে ভরা পেটে এ্যাসপিরিন বড়ি খেতে বললাম। এ্যাসপিরিন ও আরও অনেক ধরনের ব্যথা নিরাময়কারী ঔষধ খেলে কিছু সংখ্যক রোগীর রক্ত বমি ও কালো পায়খানা হতে পারে এটা ভালভাবেই জানতাম। তাই কয়েক দিন পর তাকে এক গল্পের আসরে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে কুশল জিজ্ঞাসা করলাম। সে বললো দাঁতের ব্যথা ভাল হয়ে গেছে কিন্তু কালো কালো বমি হয়েছিলো যেটা চিনির শরবত খেয়ে ভাল হয়েছে। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে সে পাকস্থলী রক্তক্ষরণ ভুগছিলো যেটা অল্পতে ভাল হয়ে গেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলাম
পাকস্থলী ক্ষুদ্র ও বৃহদন্তের বিভিন্ন অসুখের ফলে পরিপাকতন্ত্রের উপরিভাগ ও পায়খানার সাথে রক্তক্ষরণ হয়। এই প্রবন্ধে আমরা শুধু তন্ত্রের উপরিভাগ অর্থাৎ খাদ্যনালী, পাকস্থলি ও তার পরবর্তী ২৫-৩০ সেঃ ক্ষুদ্রান্তের রক্তক্ষরণ নিয়ে আলাপ করবো। বেশ কয়েকটি কারণে পরিপাকতন্ত্রের রক্তক্ষরণ হয়। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো ডুইডেনাল আলসার, গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং ননষ্টরয়েডজনিত ঔষধ (যেমন-এ্যাসপিরিন, ডাক্লেফোনাক জাতীয়) ব্যথা নিরাময়কারী ঔষধ সেবনে পাকস্থলীর ছোট ও বড় ঘা সৃষ্টি করে। ইসোফোজিয়াল ভ্যারিকস, লিভার সিরোসিস অসুখের ফলে খাদ্যনালীর রক্তনালী ফুলে ওঠা, পাকস্থলির ক্যান্সার ও ম্যালরিওয়েস টেয়ার (বার বার বমির কারণে খাদ্যনালীর নিচের অংশে ঝিল্লি ছিড়ে যাওয়া) কারনগুলিও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে পাকস্থলির আলসার জনিত প্রথম ২টি কারণই আমাদের দেশের জন্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের যে সব রোগী পাকস্থলির উপরিভাগের রক্তক্ষরণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসে তাদের একাংশের রক্তক্ষরণটি ননষ্টরয়েড জাতীয় ব্যথা নিরাময়কারী ঔষধ সেবনেরই ফল। কিছুদিন আগে আমি এক রোগীকে চিকিৎসা করেছি যে মাত্র কয়েকটি ডাইক্লেফেনাক বড়ি খাওয়ার পরে রক্তবমি নিয়ে ভর্তি হয়। এনডোসকোপ করার পর দেখলাম তার পাকস্থলি বড় একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে ১৯ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর সে জীবন রক্ষা পায়। অন্যান্য কারণগুলির পরিমাণে কম হলেও কম গুরুত্ব নয় যেমন- লিভার রোগীদের একাংশ যারা রক্তবমি নিয়ে আসে তাদের অধিকাংশ খাদ্যনালীর ভ্যারিকস থেকে রক্তক্ষরণ হ। এই ক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা অন্যান্য কারণের চেয়ে বেশি।
রক্তক্ষরণের বমির রং কালচে অথবা কফি গোলা পানির রং এ হতে পারে। অতিরিক্ত ক্ষরণ হলে বমির সাথে জমাট বাঁধা রক্ত দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে পায়খানার রং সাধারণ আলকাতরার রংয়ের মত হয়। এক্ষেত্রে সব সময় রোগীকে আয়রন ও বিসমার্থ জনিত ঔষধ সেবনের কথা জিজ্ঞাসা করার কথা মনে রাখতে হবে কারণ উপরোক্ত দুইটি ঔষধ সেবনে কাল রং এর পায়খানা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণে পায়খানার সাথে টাটকা অথবা জমাট রক্ত পড়তে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে রোগীর রক্তবমি ও কালো পায়খানা হওয়া ছাড়া রক্তক্ষরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে পায়খানার পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তক্ষরণ উপস্থিতি ধরা পড়া। কিছু রোগী মাথা ঘুরা ও বুকের ব্যথা করা বিশেষ করে হৃৎপিন্ডে রক্ত চলাচলের ব্যঘাতের কারণে ও শ্বাসকষ্ট অনুভূত হতে পারে। কালো পায়খানা ও রক্তবমি ছাড়াও রোগী অন্যান্য লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে রোগী ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারে। অনেক মাথা ঘুরা বা ঘুরে পড়ে যাওয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলা বুকে ও দ্রæত হৃৎস্পন্দন জনিত সমস্যা দেখা দেয়। শরীরের রক্তচাপ কমে যায়। এমনকি অনেকে অতিরিক্ত রক্তচাপ কমার ফলে জ্ঞান হারাতে পারেন। রক্তক্ষরণের ফলে চোখ মুখ ফ্যাকাশে দেখায়। আগেই বলেছি অনেকের বুকে ব্যাথ্যা অনুভূত হতে পারে বিশেষ করে যারা বয়স্ক এবং যাদের হৃদপিন্ডের অসুখ আছে।
Endoscope machine and procedure
পরিপাকতন্ত্রের উপরের অংশ এনডোসকপি পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তবমি ও কালো পায়খানার কারন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়াও এই পদ্ধতিতে রক্ত ক্ষরনের স্থান নির্ণয় করা হয়। সর্বোপরি এনডোসকপির মাধ্যমে পাকস্থলীর রক্তক্ষরনের আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া যায়। শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরন কোন চিকিৎসা ব্যাতিরেকে ভাল হয়ে যায়। বাকী ২০ ভাগ চিকিৎসা ছাড়া মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকে। যদি রোগ ও রোগীর বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যায় যে পুনঃরক্তক্ষরন ও মৃত্যু ঘটার সম্ভবনা কতটুকু। তবে এই অনুমান সবার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
নিউ ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আমি ক্লিনিকাল ও পোষ্ট ডক্টরেট ফেলোশিপ করার সময় পরিপাকতন্ত্রের উপরি ভাগের রক্তক্ষরন নিয়ে ৩৮০ জন রোগীর উপর একটা গবেষণা করি। এই গবেষণা দেখা যায়, যেসব রোগী বৃদ্ধ এবং যাদের অন্য কোন বড় ধরনের রোগে ভূগেছে এবং রক্ষক্ষরনের জন্য যারা ৫ ব্যাগের বেশি রক্ত গ্রহন করেছে তাদের মৃত্যু হওয়ার সম্ভবনা বেশি। এছাড়া পাকস্থলীর ক্ষতের বৈশিষ্ট্য পুনরক্তক্ষরন ও মৃত্যু ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
সেই জন্য বমি ও কালো পায়খানার রোগীকে জরুরী ভাবে হাসপাতালে পরিপাকতনতো ও লিভার বিশেষজ্ঞের অধীনে ভর্তি করতে হবে। মনে করবেন গাড়িমসি ও অবহেলার কারনে অনেক রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। উন্নত দেশে উন্নত চিকিৎসার সত্তে¡ও শতকরা ৫-১০ ভাগ রোগী পাকস্থলীর রক্তক্ষরণ জনিত কারনে মৃত্যু হয়। এ সংখ্যা আমাদের দেশের রোগীদের জন্য আরও বেশি হবে বলে আমার ধারনা। এখানে উল্লেখ্য যে লিভারের অসুখের কারনে যদি খাদ্যনালীর স্ফিত ধমনী (ভ্যারিসেস) ছিড়ে গিয়ে থাকে তাহলে মৃত্যুর সম্ভবনা কমপক্ষে শতকরা ৩০ ভাগ।
ভারিকসসে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে চিকিৎসা করা হয়। শরীরে রকতো দিয়ে ও আলসারের ঔষধ দিয়ে আলসারের চিকিতসা শুরু করা হয়। পরে দরকার হলে এনডেসকপির সাহায্যে আলসারে ইনজেকশান ও অন্যান্য পদ্ধতিতে আলসার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সার্জারী করার মাধ্যমে অণেকের চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হয়।
উপরোক্ত আলোচনা হতে এটা বুঝা যাচ্ছে রক্তবমি ও কালো পায়খানা জীবন বিপন্নকারী। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের যত সম্ভব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পরিপাকপত্র ও লিভার বিশেষেজ্ঞে অধীনে ভর্তি করা উচিত। অধিকাংশ রোগী সাধারন চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে গেলে ও একটা গুরুত্বপূর্ন অংশের এ রোগে মৃত্যু ঘটতে পারে।
Prof. Dr. Mahbub H Khan MBBS, PhD-Liver Med (Sydney) DSM (Vienna) Website: www.profmahbubhkhan.com Mobile 01911356298